
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল কর্মীদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর থেকে এই উত্তেজনা শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষে রূপ নেয়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে সংঘর্ষ বাইরের রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ে।
সংঘর্ষের সূত্রপাত
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দুপুরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্ররাজনীতির ঠিকানা, এই কুয়েটে হবে না’, ‘দাবি মোদের একটাই, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’—এমন স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাসজুড়ে বিক্ষোভ করছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে এসে পৌঁছালে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তর্ক বাধে। মুহূর্তের মধ্যেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়, যা পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও, ছাত্রদল গোপনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে ২২ ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থীকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছিল তারা। বিষয়টি সাধারণ শিক্ষার্থীদের নজরে এলে তারা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রশাসন বিষয়টি জানলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি, ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।
বহিরাগতদের হামলা ও আহত শিক্ষার্থীরা
স্থানীয় সূত্রের দাবি, দুপুর দুইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের বাইরে বিএনপি-সমর্থিত কিছু বহিরাগত এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে এবং ক্যাম্পাসে ফেলে রেখে যায়। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
সংঘর্ষের সময় বহিরাগতদের হাতে লাঠিসোঁটা, রড এবং ধারালো অস্ত্র দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বহিরাগতরা মূলত ছাত্রদলের হয়ে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষক দেবব্রত মণ্ডল বলেন,
“বিকেলের দিকে বহিরাগতদের হাতে বাঁশের লাঠি, রামদা এবং লোহার রড দেখা যায়। তারা এসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।”
অস্ত্রধারীদের ছবি ফাঁস ও সমালোচনা
সংঘর্ষের পরপরই অস্ত্রধারীদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। ফেসবুকে লতিফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন,
“ছবিগুলোতে স্পষ্ট যে হামলাকারীদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। ছাত্রদলের উচিত নিজেদের নেতিবাচক দিকগুলো চিহ্নিত করা এবং বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করিয়ে অস্ত্র তুলে দেওয়ার ভুল স্বীকার করা।”
এদিকে, দুপুরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করছিলেন, যেখানে তারা কুয়েটকে রাজনীতিমুক্ত রাখার দাবি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট কিছু শিক্ষার্থী মানববন্ধনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। এরপর বহিরাগতরা ক্যাম্পাসে ঢুকে এলোপাতাড়ি হামলা চালালে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়।
হলের ভেতর হামলা ও শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক
সংঘর্ষের সময় শুধু ক্যাম্পাসেই নয়, হল এলাকায়ও আক্রমণ চালানো হয়। বিশেষ করে যেসব হলের সীমানা প্রাচীর নেই, সেখানে বহিরাগতরা সহজেই প্রবেশ করতে পেরেছে বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থীরা জানান, চার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ এবং লাঠি-সোঁটা নিয়ে হামলা চলে। এতে বহু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন, অনেকের মাথা ফেটে যায়।
দুই পক্ষের বক্তব্য
শিক্ষার্থী মুজাহিদ ও উৎপল বলেন,
“ছাত্রদল ক্যাম্পাসে রাজনীতি চালু করার চেষ্টা করছিল এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের উসকানি দিয়ে হামলা চালায়। তারা আমাদের মানববন্ধনের মাইক কেড়ে নেয় এবং পরে বহিরাগতদের নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালায়। আমরা চাই, এই ঘটনায় জড়িত ১৮ জনকে আজীবন বহিষ্কার করা হোক।”
অন্যদিকে, ছাত্রদলের এক নেতা দাবি করেন,
“আমরা ১০-১২ জন একাডেমিক ভবন থেকে ওমর একুশে হলের দিকে যাচ্ছিলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা তখন একটি মিছিল নিয়ে আসছিল। আমরা রাস্তা ছেড়ে পাশ দিয়ে চলে যাই, কিন্তু তারা হঠাৎ আমাদের দেখে হুমকি দেয়—‘তোরা কারা? ছাত্রদল করার সাহস কোথায় পেলি?’ এরপরই ওরা আমাদের সহপাঠী ইফাজের ওপর হামলা চালায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা হলের দিকে যেতে থাকি, কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই তারা আমাদের ঘিরে ধরে এবং মারধর শুরু করে। আমি গুরুতর আহত অবস্থায় কোনোভাবে হলের ভেতর ঢুকে পড়ি, পরে স্থানীয়দের সহায়তায় হাসপাতালে যাই।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ ও প্রশাসনের বক্তব্য
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। খানজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কবির হোসেন জানান,
“ছাত্রদের দুই গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। পরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।”
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, ক্যাম্পাস থেকে রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার জন্য প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কতজন আহত হয়েছেন এবং কারা মূলত হামলার জন্য দায়ী, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। তবে শিক্ষার্থীরা একমত যে বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ বন্ধ করা এবং ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করাই বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ।
(তথ্যসূত্র: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস)